• 11 Sep, 2025

লালদিঘি: চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি

লালদিঘি: চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি

চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক, লালদিঘি। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত, এই স্থানটি চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক জীবনের অমূল্য অংশ। লালদিঘির ইতিহাস, কিংবদন্তি এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সম্পর্কে জানুন।

চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে লালদিঘি  অন্যতম। এই স্থানটি শুধুমাত্র চট্টগ্রামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ নয়, বরং শহরের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটি শহরের জেল রোডের শেষ সীমানায়  অবস্থিত, যা একসময় চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র ছিল। বর্তমানে লালদিঘি  চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নং ওয়ার্ড এর অন্তর্ভুক্ত এবং এর চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে, যেমন আন্দরকিল্লাজেলা পরিষদ ভবন  এবং স্থানীয় ব্যাংকের শাখাসমূহ।  

আরো জানুন:  লালদিঘি  

লালদিঘির ইতিহাস  

লালদিঘির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং এটি ব্রিটিশ শাসনামলে শুরুর দিকে ফিরে যায়। ১৭৬১ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিচট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করে, তখন লালকুঠি  (অথবা লাল রঙের তহসিল অফিস) তৈরি করা হয়। এই অফিসটি বর্তমানে   মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিস  হিসেবে পরিচিত। এখানে লালকুঠি  এবং এর পাশে অবস্থিত লালঘর  (লাল রঙের জেলখানা) দুইটি ব্রিটিশ শাসনকালীন গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। এই লাল রঙের ভবন দুটি চট্টগ্রামের শাসন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, এবং এখানকার ব্রিটিশ পাহারাদারেরা এই স্থান দুটো পাহারা দিতেন।  

আরো জানুন:  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি  

লালদিঘির মালিকানা  

লালদিঘির মালিকানা ইতিহাসও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৯৩৯ সালে রায় বাহাদুর রাজকুমার ঘোষ  নামে এক জমিদার এই দীঘির মালিকানা লাভ করেন। তিনি রাউজান উপজেলার চিকদাইর গ্রামে  জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি অবসর সময়ে লালদিঘির পাড়ে কাটাতেন। পরে, রাজকুমার ঘোষ লালদিঘির মালিকানা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেন। এই পরিবর্তন চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে, যা আজও স্মরণীয়। 

আরো জানুন:রাউজান  

রিকেট ঘাট  

রিকেট ঘাট  একসময় লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ছিল।   

এই ঘাটটির নামকরণ করা হয় স্যার হেনরি রিকেটস  এর নামে, যিনি ১৯৪১-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।   

এই ঘাটটি ছিল চট্টগ্রামের জমিদারদের নির্মিত এবং এটি স্যার রিকেটসের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত। রিকেটসের সময়ে চট্টগ্রামবাসীরা তার ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিলেন এবং তার অবদানের ফলে তিনি সকলের শ্রদ্ধাভাজন হন। এক সময় চট্টগ্রামের সেশন জজ টোডেল সাহেব  এর মৃত্যুর পর তার শবদেহ এখানে দাহ করা হয়, এবং এই স্থানে নির্মিত স্তম্ভটিও পরবর্তীতে ভেঙে ফেলা হয়।  

উইকিপিডিয়া:  স্যার হেনরি রিকেটস  

লালদিঘির ময়দান  

১৮৮৭ সালে   মহানরাণী ভিক্টোরিয়া  এর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল মিউনিসিপাল ময়দানে। যদিও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই মূর্তিটি অপসারণ করা হয়, তবে লালদিঘির মাঠ  বর্তমানে জনপ্রিয় একটি স্থান হিসেবে পরিচিত। ঊনবিংশ শতকের শেষে উত্তর-দক্ষিণ রাস্তাটি হওয়ার পর মিউনিসিপাল ময়দানটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশটি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠহিসেবে ব্যবহার হয়, যা আজ লালদিঘির মাঠ নামে পরিচিত। এই মাঠ বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।  

আরো জানুন:মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়  

লালদিঘির কিংবদন্তি  

চট্টগ্রামের লালদিঘি  নিয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। একবার একটি দিনমজুরের মেয়ে গোসল করতে গিয়ে পায়েই শিকল বাঁধে এবং তাকে লাল বেগম  নামক এক বাদশাহর দরবারে নিয়ে আসা হয়। বাদশা জানতেন না যে লাল বেগম তার মুল্লক থেকে পালিয়েছে। একসময়, এই মেয়ে তার আসল পরিচয় প্রকাশ করে এবং বাদশা ক্ষুব্ধ হয়ে লাল বেগম  -কে খুঁজতে শুরু করেন। এই কিংবদন্তির ভিত্তিতে লালদিঘির পানি রক্তমাখা হয়ে যায়,  যার ফলে দিঘীর পানি “লাল” হয়ে উঠে, যা আজও লোকমুখে শোনা যায়।  

আরো জানুন:চট্টগ্রামের কিংবদন্তি  

বলী খেলা  

লালদিঘির পাড়ে ১৯১০ সালে প্রথমবারের মতো আবদুল জব্বার  বলী খেলা আয়োজন করেছিলেন। এই খেলা আজও প্রতি বছর বৈশাখের ১২ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়, যা চট্টগ্রামের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে। জব্বারের বলী খেলা  আজও চট্টগ্রামের মানুষের চিত্তবিনোদনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। বর্তমানে লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে একটি সবুজ পার্ক  রয়েছে, যেখানে স্থানীয়রা সময় কাটাতে আসে এবং শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে এক ধাপ দূরে যেতে পছন্দ করে।  

আরো জানুন:বলী খেলা  


লালদিঘিচট্টগ্রামের ঐতিহ্য, ইতিহাস, এবং সংস্কৃতির এক অমূল্য নিদর্শন। এর ইতিহাস থেকে শুরু করে কিংবদন্তি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পর্যন্ত, লালদিঘি চট্টগ্রামবাসীর জন্য এক ধরনের ঐতিহাসিক প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই স্থানটি কেবল চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অংশ নয়, বরং এটি আজও চট্টগ্রামের মানুষের জীবনে একটি অমূল্য স্থান হয়ে রয়েছে। অতীতের ইতিহাস থেকে আজকের দিনের সাংস্কৃতিক চর্চা, লালদিঘি চট্টগ্রাম শহরের শিকড় ও প্রেক্ষাপটের এক অটুট প্রতীক।  

আরো জানুন:     চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাস